لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ
সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে পবিত্র কোরআন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথকে সঠিক মত ও পথ থেকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। ’ -সূরা বাকারা :২৫৬
কাফিরুন নাযিল
সুতরাং ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য। ’ -সূরা কাফিরুন : ৫
একে অন্যের ধর্ম পালন করতে গিয়ে কেউ কোনোরূপ সীমা লঙ্ঘন কিংবা বাড়াবাড়ি করবে না। অন্য কেউ যদি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেও ফেলে তবে ভুলেও যেন কোনো ইমানদার এ ধরনের হীন ও জঘন্য কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত না করে। এ বিষয়টিই নসিহতস্বরূপ মুমিনদের উদ্দেশে আল্লাহতায়ালা বলছেন,
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدُوًا بِغَيرِ عِلمٍ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাদের গালি দিও না, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবদেবীর পূজা-উপাসনা করে, কারণ, যারা শিরক থেকে আরো অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে। ’ -সূরা আনআম: ১০৮
যেখানে অন্য ধর্মের দেবতাকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ সেখানে মন্দির ভাঙচুর ও মানুষ হত্যা কীভাবে বৈধ হতে পারে? একজন প্রকৃত মুসলমান কখনোই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন কোনো কাজ করতে পারে না।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যাকারী ব্যাক্তি জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না’- বোখারী শরীফ : ৩১৬৬
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। ’ -সুনানে নাসাঈ : ৪৭৪৭
‘কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুন্ন করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি রাসুলুল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব। ’ –সুনানে আবু দাউদ : ৩০৫২
রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনের চিরাচরিত নিয়ম ছিল, যখন কোনো সেনাবাহিনী প্রেরণ করার প্রয়োজন হতো, তখন যুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন নসিহত, দিকনির্দেশনার পাশাপাশি একথা অবশ্যই বলে দিতেন যে, ‘যুদ্ধকালীন সময়ে বা যুদ্ধের পর কোনো মন্দির-গীর্জা-উপাসনালয় ভেঙে ফেলবে না। ’ -মুসান্নাফ আবি শায়বা : ৩৩৮০৪
মদিনার সদনঃ মদিনা সনদে লেখা ছিল, প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করতে পারবে।
মুসলমানদেরকে হত্যার পরিণতি
সূরা নিসার ৯৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا
“যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন ঈমানদারকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম সে চিরকাল সেখানেই থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।” (৪:৯৩)
প্রকৃত মুসলমান সেই
আল মুসলিমু মান সালিমাল মুসলিমুনা মিন লেনানি ও ইয়াদিহি।
‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে বা কষ্ট না পায়।’ অথবা ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান দ্বারা অন্য মুসলমান শান্তি পায়।’ (বুখারি শরিফ, খণ্ড: ১, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ৪, হাদিস: ৯, পৃষ্ঠা: ১৭)।
الۡفِتۡنَۃُ اَکۡبَرُ مِنَ الۡقَتۡلِ
সুরা বাকারার ২১৭
অমুসলিমদের প্রতি রসূলুল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি ব্যবহার করেছিলেন-
1.
হজরত আবুবকর ছিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার কন্যা হযরত আসমা আসমা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি রসুলুল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞেস করলাম- আমি কি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব? তিনি বললেন, হ্যা’। (বোখারি শরীফ)
২
হজরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার পেশাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক বালাতি পানি আনলেন এবং পানি পেশাবের ওপর ঢেলে দেয়া হল’। (বোখারি, কিতাবুল আদব)
৩
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদীর লাশ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সামন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তাঁর সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছিলেন, হে ইয়া রসূল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এটি তো ইহুদীর লাশ। এতে তিনি উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (বোখারি শরীফ-১৩১১)
হজরত আবু বাকারা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমদ)।
এছাড়া হাদীসে বর্ণিত আছে, তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফির হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই। তার বদ দোয়া দ্রুত কবুল হয়। মুসনাদে আহমদ
আমরা যদি সেই সময়ের ঘটনা লক্ষ্য করি যখন মক্কার লোকেরা মহানবীর (সা.) কোন কথাই যখন শুনতে চাচ্ছিল না, তখন তিনি (সা.) তায়েফের দিকে দৃষ্টি দিলেন। যখন তিনি (সা.) তায়েফ পৌছলেন, তখন সেখানকার নেতৃবৃন্দ তার সাথে দেখা করার জন্য আসতে লাগলো। কিন্তু কেউই সত্য গ্রহণ করতে রাজী হলো না। তায়েফের কাফেররা ছেলেদেরকে লেলিয়ে দিল এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তারা নির্মমভাবে মহানবীর (সা.) ওপর পাথর ছুঁড়তে থাকে। অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবীকে (সা.) শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। শ্রেষ্ঠ রাসুলের দু’টি পা রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। তারপরও তারা ঠান্ডা হলো না, যতক্ষণ না তিনি (সা.) শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে এসে পৌছলেন। এই লোকগুলো যখন তার পিছু পিছু ধাওয়া করছিল, তখন তিনি এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে, আল্লাহর গজব না আবার তাদের ওপর পড়ে।
তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিলেন এবং কাতর প্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না, এরা কি করছে।’ একটু ভেবে দেখুন, আঘাতে জর্জরিত ও লোকদের তাড়া খেয়ে তার শরীরে চলার মত আর শক্তি ছিল না। এত কিছুর পরও তিনি (সা.) তাদের অভিশাপ দেননি বরং তাদের জন্য দোয়াই করেছেন।
এমনই ছিলো মানবদরদী রাসুল, শ্রেষ্ঠ রাসুল মহানবীর (সা.) আদর্শ। আমরা যদি মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্যান্যা ধর্মাবলম্বীদের সাথে আর একই শিক্ষা আমাদেরকে দিয়ে গেছেন।